মেয়েটির নাম যখন সুভাষিণী রাখা হয়েছিল তখন কে জানিত সে বাঁচিবে সে বোবা হইবে। তাহার দুটি বড়ো বোনকে সুখেশিনী ও সুশাহিনী নাম দেওয়া হইয়াছিল, তাই মিলের অনুরোধে তাহার বাপ ছোটো মেয়েটির নাম সুভাষিণী রাখে। এখন সকল তাহাকে সংক্ষেপে সুবা বলে।
দর্শনমতে অনুধ্যান ও অর্থসাধ্য বড্ড দুটি মেয়ের বিবাহ হইয়া গেছে, এখন ছোটোটির পিতামাতার নীরব হৃদয়ভারে মতো বিরাজ করিতেছে।
যে কথা কহা না সে যে অনুভব করেও ইহা সকলের মনে হয় না, এইজন্য তাহার সান্নিধ্যে সকলেই তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করিত। সে যে বিধাতার অভিশাপস্বরূপ তাহার পিতৃতুল্য আশ্রয় জন্মগ্রহণ করিয়াছে এ কথা সে শিশুকাল হইতেই বুদ্ধিমতী হইয়াছিল। তাহার ফল এই হইয়াছিল, সাধারণের দৃষ্টিপথ হইতে সে আপনাকে গোপন করিয়া রাখিবার চেষ্টা করিত। মনে করিত, আমাকে সবাই তুচ্ছ তুলিয়া বাঁটি। কিন্তু, বেদনা কি কেহ করিতে ভুলে? পিতামাতার মনে সে সর্বদাই জাগ্রত ছিল।
বিস্ময়কর, তাহার মা তাহাকে নিজের একটি কৃতিত্বরূপে দেখিতেন; কেননা, মাতার মতে, প্রত্যেক কন্যাকে নিজের অঙ্গরূপে দেখিয়া কন্যার কোনো অপূর্ণতাকে দেখিলে সেটা যেন বিবাহসম্বন্ধে নিজের লজ্জার কারণ বলিয়া মানা করিতেন। বরঞ্চ, কন্যার পিতা ব্যক্তিগত স্নেহের দ্বারা তাহার অন্য মেয়েদের অপেক্ষা সুবাকে একটুখানি বেশি ভালবাসিতেন; কিন্তু মাতার তাহাকে নিজের দৃষ্টিপথে রাখিবার চেষ্টা তাহার প্রতি বড়ো বিস্ময়কর ছিল। সুবার দোষ ছিল না, কিন্তু তাহার নির্দ্বিধাস্বভাবিকতা বড়ো বড়ো লোকের চোখে বিস্ময়কর হইত। তাহার অবস্থার কথা ভুলিয়া সেও তাহাদের সঙ্গে অনায়াসে উঠিতে বসিতে পারিত।
কথায় আমাদের যেভাবে প্রকাশ করি সেটা আামসনিকভাবে অনেকটা নিজের চেষ্টা পণ্ডিত দেখাতে চাওয়া হয়, কষ্টকরও তেমনি করা মনে হয়। সবসময় সেটা ঠিক হয় না, স্বাভাবিকভাবে অনেক সময় ভুলও হয়। কিন্তু কারো চোখকে কিছু উজ্জ্বল করিতে হয় না – মন আপনার তাহার দ্বারা উজ্জ্বল হইয়া ফেলে। যখন আপনি তাহার উপর করুণ প্রার্থনার করিতে মুগ্ধিত হন, কথায় উজ্জ্বলতার জ্বালা উঠে, যখন প্রাণান্তর নিবিড় আলো, তখন চক্ষুর ভাষা চিরদিন দমিত হইয়া থাকিবে না, তখনই দৃষ্টিতে চঞ্চল বেদনার মধ্যেও দিব্যশিখার চিকির্ণ হইবে। তাহার উপর করুণার ভাজা থাকে, তাহার চোখের ভাষা আমি উদার হইয়া অন্তর্যামী প্রভুতে অনন্তরূপের মূর্তি–অনন্তস্রোতের অক্ষয় স্রোতের উপর ছায়ালোকে বিলীন করিয়া দিই। এই বাহ্যবাণী মানুষকে মাঝে মধ্যে প্রকৃতির মতই একটি চিরন্তন আনন্দের মধ্যে সমস্ত সাধারণ বাস্তবতার মধ্যে একরকমভাবে মিশাইয়া দেয়, তাহার সহিত মানুষের চিরন্তন অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ মিলন ঘটাইয়া দেয়।
গ্রামের নাম ছোট্রী। নদীর বাঁকলিপির একটি ছোটো নদী, মেয়েটির মনের মতো, বড়দর পর্যন্ত তাহার প্রাণ নেই; নির্জনতা ভরা নদীটি কেবল তাহার প্রাণের কাহিনি কার্য করিয়া যায়। দুই ধারেই বাঁশের সমুদ্রতলের সঙ্গে তাহার যেন একটা-না-একটা সম্পর্ক আছে। দুই ধারের বেলেপাড় এবং উঁচু ছাউনি উঁচু ডিঙার ছায়াময়ী প্রতিশ্রুতিতে আধ্যাত্মিকতরূপে দ্রুত পদক্ষেপে প্রবৃত্ত হৃদয়ের আপনাকে অসংখ্য কল্যাণকার্যে চালাইতেছে।
বাঁকলিপির ঘর নদীর একেবারে উপকূলেই। তাহার বাঁশবনের বেড়া, আটচালা, গোপালমন্দির, টেক্কেমালা, খড়ের ছাউনি, তেতুলতলা, আম কাঁঠাল এবং কলার বাগান লোকলাভী-যাত্রাকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই গৃহস্থ সচেতনতার মধ্যে বোবা মেয়েটিও হারাইয়া নজরে পড়ে যে না জানি না, কিন্তু কাজকর্মে যখনই অবসর পায় তখনই সে এই লতাপাতার আসিয়া করে।
প্রকৃতি যেমন মানুষে তাহার অন্তঃপুর পূর্ণ করিয়া দেয়। যেমন তাহার হইয়াছিল কথার কথা। লীলার কল্যাণবাণী, লীলার কল্যাণকীর্তি, শিলার সৌন্দর্য, নদীর শীতল ধ্বনি, ভোরের শিশিরদল–এ-সবই তাহার মনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া তাহাকে নিখুঁত করিয়া তুলিয়াছে। তাহার মনের ভাবনা সমস্ত দৃশ্যের উপর দাগ করিয়া রেখাছে। প্রয়োজন এই বিশেষ শব্দ এবং রঙিন গতি, ইহার বোবা ভাষা–যখন বড়ো মেয়েটি সুবাকে দেখায় তাহার চোখে বিস্ময়ের বিহার: নির্জনদ্বীপের তৃণভূমি হইতে ললিতভাষী কল্যাণবাণী পর্যন্ত কেনই ইহিত, ভালি, সংলিপ্ত, কোমল এবং স্নিগ্ধমান।
এবং মাঝরাতে যখন মাগির জোলার খাইতে হইত, গৃহস্থের ঘরোয়া, পারিবারিক অভ্যাস না, শোণালোকও সত্য থাকে, তাহার সকল সময় গৃহকোণে আমলযোগ্য সহগায়িকা উপস্থিত থাকিত তাহার বিস্ময়ের কারণ করিয়া বর্ণনা করিত। এই প্রকৃতি এবং একটি রাত্রে একদিন প্রকৃতির সেই সমস্ত লীলার মূলতত্ত্ব চুপ করিয়া বর্ণনা করিত–একজন করুণীর রোলার, গান-এককণার মধুর জপকার্যে।
সুভার যে গুটিকতক অন্তরঙ্গ বন্ধুর দল ছিল না তাহা নহে। গোয়ালের দুটি গাভী, তাহাদের নাম সর্বশী ও পাঙ্গুলি। সে নাম বালিকার মুখে তাহারা কখনো শুনে নাই, কিন্তু তাহার পদশব্দ তাহারা চিনিত- তাহার কথাহীন একটা করুণ সুর ছিল, তাহার মর্ম তাহারা ভাষার অপেক্ষা সহজে বুঝিত। সুভা কখন তাহাদের আদর করিতেছে, কখন ভর্ৎসনা করিতেছে, কখন মিনতি করিতেছে, তাহা তাহারা মানুষের অপেক্ষা ভালো বুঝিতে পারিত।
সুভা গোয়ালে ঢুকিয়া দুই বাহুর দ্বারা সর্বশীর গ্রীবা বেষ্টন করিয়া তাহার কানের কাছে আপনার গণ্ডদেশ ঘর্ষণ করিত এবং পাঙ্গুলি স্নিগ্ধদৃষ্টিতে তাহার প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া তাহার গা চাটিত। বালিকা দিনের মধ্যে নিয়মিত তিনবার করিয়া গোয়ালঘরে যাইত, তাহা ছাড়া অনিয়মিত আগমনও ছিল; গৃহে যেদিন কোনো কঠিন কথা শুনিত সেদিন সে অসময়ে তাহার এই মুক বন্ধু দুটির কাছে আসিত- তাহার সহিষ্ণুতাপরিপূর্ণ বিষাদশান্ত দৃষ্টিপাত হইতে তাহারা কী একটা অন্ধ অনুমানশক্তির দ্বারা বালিকার মর্মবেদনা যেন বুঝিতে পারিত, এবং সুভার গা ঘেঁষিয়া আসিয়া অল্পে অল্পে তাহার বাহুতে শিং ঘষিয়া ঘষিয়া তাহাকে নির্বাক ব্যাকুলতার সহিত সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিত।
ইহারা ছাড়া ছাগল এবং বিড়ালশাবকও ছিল; কিন্তু তাহাদের সহিত সুভার এরূপ সমকক্ষভাবে মৈত্রী ছিল না, তথাপি তাহারা যথেষ্ট আনুগত্য প্রকাশ করিত। বিড়ালশিশুটি দিনে এবং রাত্রে যখন-তখন সুভার গরম কোলটি নিঃসংকোচে অধিকার করিয়া সুখনিদ্রার আয়োজন করিত এবং সুভা তাহার গ্রীবা ও পৃষ্ঠে কোমল অঙ্গুলি বুলাইয়া দিলে যে তাহার নিদ্রাকর্ষণের বিশেষ সহায়তা হয়, ইঙ্গিতে এরূপ অভিপ্রায়ও প্রকাশ করিত।
উন্নত শ্রেণির জীবের মধ্যে সুভার আরও একটি সঙ্গী জুটিয়াছিল। কিন্তু তাহার সহিত বালিকার ঠিক কিরূপ সম্পর্ক ছিল তাহা নির্ণয় করা কঠিন, কারণ, সে ভাষাবিশিষ্ট জীব; সুতরাং উভয়ের মধ্যে সমভাষা ছিল না।
গোঁসাইদের ছোটো ছেলেটি- তাহার নাম প্রতাপ। লোকটি নিতান্ত অকর্মণ্য। সে যে কাজকর্ম করিয়া সংসারের উন্নতি করিতে যত্ন করিবে, বহু চেষ্টার পর বাপ-মা সে আশা ত্যাগ করিয়াছেন। অকর্মণ্য লোকের একটা সুবিধা এই যে, আত্মীয় লোকেরা তাহাদের উপর বিরক্ত হয় বটে, কিন্তু প্রায় তাহারা নিঃসম্পর্ক লোকদের প্রিয়পাত্র হয়- কারণ, কোনো কার্যে আবন্ধ না থাকাতে তাহারা সরকারি সম্পত্তি হইয়া দাঁড়ায়। শহরের যেমন এক-আধটা গৃহসম্পর্কহীন সরকারি বাগান থাকা আবশ্যক তেমনি গ্রামে দুই-চারিটা অকর্মণ্য সরকারি লোক থাকার বিশেষ প্রয়োজন। কাজে-কর্মে আমোদে-অবসরে যেখানে একটা লোক কম পড়ে সেখানেই তাহাদিগকে হাতের কাছে পাওয়া যায়।
প্রতাপের প্রধান শখ- ছিপ ফেলিয়া মাছ ধরা। ইহাতে অনেক সময় সহজে কাটানো যায়। অপরাহ্ণে নদীতীরে ইহাকে প্রায় এই কাজে নিযুক্ত দেখা যাইত। এবং এই উপলক্ষে সুভার সহিত তাহার প্রায় সাক্ষাৎ হইত। যে-কোনো কাজেই নিযুক্ত থাক, একটা সঙ্গী পাইলে প্রতাপ থাকে ভালো। মাছ ধরার সময় বাক্যহীন সঙ্গীই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ- এইজন্য প্রতাপ সুভার মর্যাদা বুঝিত। এইজন্য, সকলেই সুভাকে সুভা বলিত, প্রতাপ আর-একটু অতিরিক্ত আদর সংযোগ করিয়া সুভাকে ‘সু’ বলিয়া ডাকিত।
সুভা তেঁতুলতলায় বসিয়া থাকিত এবং প্রতাপ অনতিদূরে ছিপ ফেলিয়া জলের দিকে চাহিয়া থাকিত। প্রতাপের জন্য একটি করিয়া পান বরাদ্দ ছিল, সুভা তাহা নিজে সাজিয়া আনিত। এবং বোধ করি অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া চাহিয়া ইচ্ছা করিত, প্রতাপের কোনো-একটা বিশেষ সাহায্য করিতে, একটা-কোনো কাজে লাগিতে, কোনোমতে জানাইয়া দিতে যে এই পৃথিবীতে সেও একজন কম প্রয়োজনীয় লোক নহে। কিন্তু কিছুই করিবার ছিল না।
তখন সে মনে মনে বিধাতার কাছে অলৌকিক ক্ষমতা প্রার্থনা করিত। মন্ত্রবলে সহসা এমন একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটাইতে ইচ্ছা করিত যাহা দেখিয়া প্রতাপ আশ্চর্য হইয়া যাইত, বলিত, ‘তাই তো, আমাদের সুভির যে এত ক্ষমতা তাহা তো জানিতাম না।’
মনে করো, সুভা যদি জলকুমারী হইত; আস্তে আস্তে জল হইতে উঠিয়া একটা সাপের মাথার মণি ঘাটে রাখিয়া যাইত: প্রতাপ তাহার তুচ্ছ মাছধরা রাখিয়া সেই মানিক লইয়া জলে ডুব মারিত; এবং পাতালে গিয়া দেখিত, রুপার অট্টালিকায় সোনার পালঙ্কে কে বসিয়া? আমাদের বাণীকন্ঠের ঘরের সেই বোবা মেয়ে সু— আমাদের সু সেই মণিদীপ্ত গভীর নিস্তব্ধ পাতালপুরীর একমাত্র রাজকন্যা। তাহা কি হইতে পারিত না, তাহা কি এতই অসম্ভব?
আসলে কিছুই অসম্ভব নয়, কিন্তু তবুও সু প্রজাশূন্য পাতালের রাজবংশে না জন্মিয়া বাণীকন্ঠের ঘরে আসিয়া জন্মিয়াছে এবং গোঁসাইদের ছেলে প্রতাপকে কিছুতেই আশ্চর্য করিতে পারিতেছে না।
সুভার বয়স ক্রমেই বাড়িয়া উঠিতেছে। ক্রমে সে যেন আপনাকে আপনি অনুভব করিতে পারিতেছে। যেন কোনো একটা পূর্ণিমাতিথিতে কোনো-একটা সমুদ্র হইতে একটা জোয়ারের স্রোত আসিয়া তাহার অন্তরাত্মাকে এক নূতন অনির্বচনীয় চেতনাশক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতেছে। সে আপনাকে আপনি দেখিতেছে, ভাবিতেছে, প্রশ্ন করিতেছে, এবং বুঝিতে পারিতেছে না।
গভীর পূর্ণিমারাত্রে সে এক-একদিন ধীরে শয়নগৃহের দ্বার খুলিয়া ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়াইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখে। পূর্ণিমাপ্রকৃতিও সুভার মতো একাকিনী সুপ্ত জগতের উপর জাগিয়া বসিয়া— যৌবনের রহস্যে, পুলকে, বিষাদে, অসীম নির্জনতার একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত, এমন-কি, তাহা অতিক্রম করিয়াও ধমথম করিতেছে, একটি কথা কহিতে পারিতেছে না। এই নিস্তব্ধ ব্যাকুল প্রকৃতির প্রান্তে একটি নিস্তব্ধ ব্যাকুল বালিকা দাঁড়াইয়া।
এ দিকে কন্যাভারগ্রস্ত পিতামাতা চিন্তিত হইয়া উঠিয়াছেন। লোকেও নিন্দা আরম্ভ করিয়াছে। এমন-কি, এক-ঘরে করিবে এমন জনরবও শুনা যায়। বাণীকন্ঠের সচ্ছল অবস্থা, দুই বেলাই মাছভাত খায়, এজন্য তাহার শত্রু ছিল।
স্ত্রীপুরুষে বিস্তর পরামর্শ হইল। কিছুদিনের মতো বাণী বিদেশে গেল। অবশেষে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “চলো, কলিকাতায় চলো।”
বিদেশযাত্রার উদ্যোগ হইতে লাগিল। কুয়াশা-ঢাকা প্রভাতের মতো সুভার সমস্ত হৃদয় অশ্রুবাষ্পে একেবারে ভরিয়া গেল। একটা অনির্দিষ্ট আশঙ্কা বশে সে কিছুদিন হইতে ক্রমাগত নির্বাক জন্তুর মতো তাহার বাপ-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিত। ডাগর চক্ষু মেলিয়া তাঁহাদের মুখের দিকে চাহিয়া কী একটা বুঝিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু তাঁহারা কিছু বুঝাইয়া বলিতেন না।
ইতিমধ্যে একদিন অপরাহ্ণে ছিপ ফেলিয়া প্রতাপ হাসিয়া কহিল, “কী রে সু, তোর নাকি বর পাওয়া গেছে, তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস? দেখিস আমাদের ভুলিস নে।” বলিয়া আবার মাছের দিকে মনোযোগ করিল।
মর্মবিদ্ধ হরিণী ব্যাধের দিকে যেমন করিয়া তাকায়, নীরবে বলিতে থাকে ‘আমি তোমার কাছে কী দোষ করিয়াছিলাম’, সুভা তেমনি করিয়া প্রতাপের দিকে চাহিল। সেদিন গাছের তলায় আর বসিল না। বাণীকণ্ঠ নিদ্রা হইতে উঠিয়া শয়নগৃহে তামাক খাইতেছিলেন, সুভা তাঁহার পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল। অবশেষে তাহাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়া বাণীকন্ঠের শুষ্ক কপোলে অশ্রু গড়াইয়া পড়িল।
কাল কলিকাতায় যাইবার দিন স্থির হইয়াছে। সুভা গোয়ালঘরে তাহার বাল্য-সখীদের কাছে বিদায় লইতে গেল। তাহাদিগকে স্বহস্তে খাওয়াইয়া, গলা ধরিয়া একবার দুই চোখে যত পারে কথা ভরিয়া তাহাদের মুখের দিকে চাহিল। দুই নেত্রপল্লব হইতে টপ টপ করিয়া অশ্রুজল পড়তে লাগিল।
সেদিন শুক্লাদ্বাদশীর রাত্রি। সুভা শয়নগৃহ হইতে বাহির হইয়া তাহার সেই চিরপরিচিত নদীতটে শল্পশয্যায় লুটাইয়া পড়িল। যেন ধরণীকে, এই প্রকাণ্ড মূক মানবতাকে দুই বাহুতে ধরিয়া বলিতে চাহে— ‘তুমি আমাকে যাইতে দিয়ো না মা, আমার মতো দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখো।’
[সংক্ষেপিত]